শতবর্ষের ঐতিহ্যে লালিত আনন্দ মোহন কলেজ বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কলেজগুলোর অন্যতম। এ কলেজের রয়েছে এক সমৃদ্ধ ও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। আনন্দ মোহল কলেজ ১৯০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর কার্যক্রম শুর" হয় ১৯০৯ সালে। এই মহান উদ্য্যোগের সঙ্গে যাঁর নাম জড়িয়ে আছে, তিনি হচ্ছেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক, সমাজসংস্কারক ব্যারিস্টার আনন্দমোহন বসু ১৮৮৩ সালে ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ শহরের রাম বাবু রোডে তাঁর পৈত্রিক বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করে "ময়মনসিংহ ইনস্টিটিউশন”। আনন্দমোহন বসু ১৮৮২ সালে ভারত সরকার কর্তৃক গঠিত প্রথম শিক্ষা কমিশনের অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। তাছাড়া তিনি কলকাতার সিটি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। কলকাতার বেশকিছু গণ্যমান্য শিক্ষাবিদ নিয়ে গঠিত একটি কাউন্সিল সিটি কলেজ পরিচালনা করতেন, আনন্দমোহন বসু ছিলেন সেই কাউন্সিলের সভাপতি।
১৯৮০ সালের এপ্রিল মাস থেকে ময়মনসিংহ ইনস্টিটিউশন "ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট স্কুল” নামে অভিহিত হয়। ১৮৯৯ সালে আনন্দমোহন বসু কলকাতা থেকে ময়মনসিংহ এলে ময়মনসিংহের স্থানীয় উৎসাহী অধিবাসীগণ ছাড়াও "ময়মনসিংহ সভা” এবং "আঞ্জুমানে ইসলামিয়া” এর যৌথ আবেদনে ময়মনসিংহে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবী জানানো হয়। এ দাবীর পরিপ্রেক্ষীতে কলকাতা সিটি কলেজ কাউন্সিলের সভাপতি আনন্দমোহন বসু ১৯০১ সনের ১৮ জুলাই সিটি কলেজিয়েট স্কুলকে ‘ময়মনসিংহ সিটি কলেজ’ নামে দ্বিতীয় শ্রেণীর কলেজে রূপান্তর করে এবং একে কলকাতার সিটি কলেজের সাথে যুক্ত করেন। প্রাথমিক অবস্থায় কলকাতা সিটি কলেজ কাউন্সিলের আর্থিক সহযোগিতায় ময়মনসিংহ সিটি কলেজ পরিচালিত হতো, পরের বছর ১৯০২ সালের এপ্রিল মাসে এটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক দ্বিতীয় গ্রেডের কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ইতোমধ্যে স্থানীয় অধিবাসীদের অর্থ সাহায্যে কলেজের পুরোবাগে রাস্তার পাশে কলেজের জন্য পাকা ভবন নির্মিত হয়।
১৯০৬ সালে আনন্দমোহন বসুর মৃত্যুর পর ময়মনসিংহ সিটি কলেজ নানা সংকটের সম্মুখীন হয়। প্রথমত কলকাতা সিটি কলেজ কাউন্সিল অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে ময়মনসিংহ সিটি কলেজকে কলকাতার সিটি কলেজ থেকে বিযুক্তকরণের জন্য কলাকতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকট দাবী পেশ করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৮ সালের ৩১ মার্চ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক কলকাতা সিটি কলেজ থেকে ময়মসসিংহ সিটি কলেজের সংযুক্তি সম্পূর্ণর"পে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এই অবস্থায় কলেজের কার্যক্রম একপ্রকার বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তখন প্রিন্সিপাল বৈকুন্ঠনাথ চক্রবর্তী কলেজটির পুনর্গঠনের উদ্যোগে নেন এবং তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. জে. আর. ব্ল্যাকউডের শরণাপন্ন হন। মিদ জে. আর. বল্যাকউড স্থানীয় শিক্ষাবিদ ও উদ্যমী ব্যক্তিদের নিয়ে একটি নতুন কমিটি গঠন করে " ময়মনসিংহ কলেজ ” নামে কলেজটিকে পুনুজ্জবীত করেন। এ কমিটি কলেজের পরিচালনা ও যাবতীয় খরচের দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং কলেজের জন্য তহবিল ও নতুন জায়গা সংগ্রহের জোরালো প্রচেষ্টা গ্রহন করে। তৎকালীন ভাবরত সরকারের গ্রান্ট-ইন-এইড- এর আওতায় অর্থ সাহায্য প্রদােেনর জন্য বিভাগীয় কমিশনার এর সাথে কমিটি সাক্ষাৎ করে।
বিভাগীয় কমিশানার কলেজের নতুন ভবন নির্মাণের জন্য ৫৫,০০০/-(পঞ্চান্ন হাজার) টাকা বরাদ্দ দেন। পাশাপাশি কলেজের সার্বিক উন্নতির জন্য স্থানীয় কয়েকজন জমিদার ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিগতভাবে ১,১৮,৩৯৫/- (এক লক্ষ আঠার হাজার তিনশত পঁচানব্বই) টাকা এককালীন অনুদান প্রদান করেন। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের নাম ও অনুদানের পরিমাণ নিন্মর"প:
১. মহারাজা শশীকান্ত আচার্য্য চৌধুরী (মুক্তাগাছা) ৪৫,০০০/- টাকা
২. রাজা যোগেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ( রামগোপালপুর ) ৩০,০০০/- টাকা
৩. রাণী দিনমনি চৌধুরাণী ( সন্তোষ) ২০,০০০/- টাকা
৪. বাবু হেমচন্দ্র চৌধুরী (আম্বারিয়া) ১০,০০০/- টাকা
৫. রাজা জগতকিশোর রায় চৌধুরী (গৌরীপুর) ৫,৫০০/- টাকা
৬. বাবু প্রমথনাথ রায় চৌধুরী ( সন্তেষ) ৫,০০০/- টাকা
৭. রাণী হেমন্ত কুমারী দেবী (পুটিয়া) ১,০০০/- টাকা
৮. শ্রীমতি বামা সুন্দরী দেবী (ভবানীপুর) ১,০০০/- টাকা
ময়মনসিংহ জেলার প্রথম মুসলিম গ্র্যাজুয়েট, আনন্দমোহন বসুর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের সহপাঠী বন্ধু, আঞ্জুমানে ইসলামিয়া - এর সভাপতি ও বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী মৌলভী হামিদ উদ্দিন আহমদ কলেজের জন্য কাঁচিঝুলীতে ২৬ বিঘা জমি দান করেন এবং তার বন্ধু আনন্দমোহন বসুর নামে কলেজটির নামকরণের প্রস্তাব করেন। মৌলভী হামিদ উদ্দিন ছাড়াও তার জমির পাশ্ববর্তী আরো কয়েক বিঘা জায়গা স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ কলেজের জন্য দান করেন। সরকারি-বেসরকারি নানা উৎস থেকে সংগৃহীত অর্থ এবং জমি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কলেজটি কাঁচিঝুলীর বর্তমান স্থানে স্থানান্তরের ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়। নতুন ভব নির্মানসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করে ১৯০৮ সালের শেষের দিকে "ময়মনসিংহ কলেজ” এর নাম পরিবর্তন করে মৌলভী হামিদ উদ্দিন এর প্রস্তাবমতো কলেজের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা আনন্দমোহন বসুর নামানুসারে " আনন্দ মোহন কলেজ ” রাখা হয় এবং শিক্ষা কার্যক্রম পুনরায় চালু করা হয়। কয়েক বছরের মধ্যেই এটি একটি প্রথম শ্রেণীর কলেজে উন্নীত হয়। ফলে ১৯১৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এটিকে প্রথম গ্রেডের কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। কলেজের সার্বিক উন্নয়নে ময়মনসিংহ পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান রায় বাহাদুর শ্যামাচরণ রায় এর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়।
১৯১৪ সালে কলেজটি প্রথম গ্রেডে উন্নীত হওয়ার পর থেকে কলেজরি খ্যাতি এবং ছাত্রসংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং কালকমে এটি এতদঞ্চললের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে । ১৯৬৪ সালের অক্টোবরে কলেজকিে সরকারিকরণ করা হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ‘ বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার পর কলেজের ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ একাডেমিক কার্যক্রমে নতুন গতি সঞ্চার হয়। শিক্ষকের পদ সংখ্যা বৃদ্ধি, নতুন নতুন বিভাগ প্রতিষ্ঠা, ছাত্রাবাস, ছাত্রীনিবাস ও একাডেমিক ভবন নির্মিত হয়। ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯০৮ সালে প্রতিষ্ঠাকালে যেখানে আনন্দ মোহন কলেজে ছাত্র ছিল ১৭৮ জন এবং শিক্ষক ছিলেন ৯জন, সেখানে বর্তমানে ছাত্র সংখ্যা প্রায় ২৫,০০০ এবং শিক্ষকের পদ ২০১টি। বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিক কোর্সসহ ১৮টি বিষয়ে অনার্স ও মাষ্টার্স কোর্স চালু আছে। ছাত্রদের জন্য ৩টি ছাত্রাবাস এবং ছাত্রীদের জন্য ২টি ছাত্রীনিবাস রয়েছে। প্রায় অর্ধলক্ষ পুস্তকসমৃদ্ধ একটি কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি রয়েছে। তাছাড়া প্রতি বিভাগে রয়েছে বিষয়ভিত্তিক পুস্তকসমৃদ্ধ সেমিনার-লাইব্রেরি। কলেজে বিএনসিসি, রোভার স্কাউট কার্যক্রম চালু রয়েছে। একাডেমিক কার্যক্রমের পাশাপাশি খেলাধূলা, সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা প্রভৃতি শিক্ষা সহায়ক কর্মকান্ডের ব্যবস্থা রয়েছে।